বাতাসের চাপ (Air Pressure)

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - পদার্থ বিজ্ঞান - পদার্থের অবস্থা ও চাপ (State of matter and pressure) | | NCTB BOOK

বাতাসের একটা চাপ আছে । আমরা এই চাপ আলাদাভাবে অনুভব করি না কারণ আমাদের শরীরের ভেতর থেকেও বাইরে একটি চাপ দেওয়া হচ্ছে। তাই দুটো চাপ একটা আরেকটিকে কাটাকাটি করে দেয়। মহাকাশে বাতাস নেই, তাই বাভাসের চাপও নেই, তাই সেখানে শরীরের ভেতরের চাপকে কাটাকাটি করার জন্য কিছু নেই এবং এ রকম পরিবেশে মুহূর্তের মাঝে মানুষের শরীর তার ভেতরকার চাপে বিস্ফোরিত হয়ে যেতে পারে। সে জন্য মহাকাশে মহাকাশচারীরা সব সময়ই চাপ নিরোধক স্পেস স্যুট পরে থাকেন। পৃথিবী পৃষ্ঠে বাতাসের এই চাপ 10 Nm-2 যার অর্থ তুমি যদি পৃথিবী পৃষ্ঠে 1 m2 ক্ষেত্রফলের খানিকটা জায়গা কল্পনা করে নাও তাহলে তার উপরে বাতাসের যে স্তম্ভটি রয়েছে তার ওজন 105 N, এটা মোটামুটিভাবে একটা হাতির ওজন। 

এখানে একটা বিষয় এখনই তোমাদের খুব ভালো করে বুঝতে হবে, এটি সত্যি, ওজন হচ্ছে বল এবং এই বলটি নিচের দিকে কাজ করে। বল হচ্ছে ভেক্টর তাই এর মান এবং দিক দুটোরই প্রয়োজন আছে। চাপ ভেক্টর নয় তার কোনো দিক নেই তাই যেকোনো জায়গায় চারদিকে সমান। তুমি যেখানে এখন দাঁড়িয়ে কিংবা বসে আছো তোমার ওপর বাতাস যে চাপ প্রয়োগ করছে, সেটা তোমার উপরে ডানে বামে সামনে পেছনে বা নিচে চারদিকেই সমান। বাতাস কিংবা তরল পদার্থের জন্য এটা সব সময়ই সত্যি। 

পাতলা টিন বা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি কোনো নিশ্ছিদ্র টিন বা কৌটা যদি কোনোভাবে বায়ুশূন্য করা যায় তাহলে সেটা একটা সমতা বজায় রেখেছিল। ভেতরের বাতাস পাশ করে সরিয়ে নেবার পর ভেতরে বাইরের বাতাসের চাপ প্রতিহত করার মতো কিছু নেই, তাই বাইরের বাতাসের চাপ টিন বা কৌটাকে দুমড়েমুচড়ে দেবে । তোমরা যে জিনিসটা লক্ষ করবে সেটি হচ্ছে কৌটাটা শুধু উপর দিক থেকে দুমড়েমুচড়ে যাবে না। চারদিক থেকে দুমড়েমুচড়ে যাবে। চাপ যদি শুধু উপর থেকে আসত তাহলে টিনটা শুধু উপর থেকে দুমড়েমুচড়ে যেত। চাপ যেহেতু চারদিকেই সমান তাই টিনটা চারদিক থেকেই আসছে এবং চারদিক থেকে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। 

 

 

পৃথিবী পৃষ্ঠে বাতাসের চাপটি আসছে এর উপরের স্তম্ভটির ওজন থেকে। তাই আমরা যদি উপরে উঠি তাহলে আমাদের উপরের স্তম্ভের উচ্চতাটুকু কমে যাবে, ওজনটাও কমে যাবে এবং সেজন্য সেখানে বাতাসের চাপও কমে যাবে। বাতাস বা গ্যাসকে চাপ দিয়ে সংকুচিত করা যায়। তাই পৃথিবীর পৃষ্ঠে, যেখানে বাতাসের চাপ সবচেয়ে বেশি সেখানে বাতাস সবচেয়ে বেশি সংকুচিত হয়ে আছে অর্থাৎ বাতাসের ঘনত্ব সেখানে সবচেয়ে বেশি। আমরা যতই উপরে উঠতে থাকব বাতাসের চাপ যে রকম কমতে থাকবে তার ঘনত্বও সে রকম কমতে থাকবে। 

উচ্চতার সাথে সাথে বাতাসের ঘনত্ব কমে যাওয়ার অনেকগুলো বাস্তব দিক আছে। আকাশে যখন প্লেন উড়ে তখন বাতাসের ঘর্ষণ প্লেনের জন্য অনেক বড় সমস্যা। যত উপরে ওঠা যাবে বাতাসের ঘনত্ব তত কমে যাবে এবংঘর্ষণও কমে যাবে ভাই সত্যি সত্যি বড় বড় যাত্রীবাহী প্লেন আকাশে অনেক ওপর দিয়ে উড়ার চেষ্টা করে। সাধারণভাবে মনে হতে গারে তাহলে প্লেনগুলো আরো উপর দিয়ে, একেবারে মহাকাশ দিয়ে উড়ে যায় না কেন, তাহলে তো ঘর্ষণ আরো কমে যাবে। তার কারণ প্লেনকে ওড়ানোর জন্য তার শক্তিশালী ইঞ্জিন দরকার আর সেই ইঞ্জিনে জ্বালানি জ্বালানোর জন্য অক্সিজেন দরকার। উপরে যেখানে বাতাসের ঘনত্ব কম সেখানে অক্সিজেনও কম, তাই বেশি উচ্চতায় অক্সিজেনের অভাব হয়ে যার বলে প্লেনের ইঞ্জিন মহাকাশে কাজ করবে না | 

যারা পর্বতশৃঙ্গে ওঠে তাদের জন্যও সেই একই সমস্যা। যত উপরে উঠতে থাকে সেখানে বাতাসের চাপ কমে যাওয়ার সমস্যা থেকে অনেক বড় সমস্যা বাভাসের ঘনত্ব কমে যাওয়ার কারণে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া। যারা পর্বতারোহণ করে সেজন্য তাদের অত্যন্ত কম অক্সিজেনে শুধু বেঁচে থাকা নয় পর্বতারোহণের মতো অভ্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ করা শিখতে হয়, সেজন্য তাদের শরীরকেও প্রস্তুত করতে হয়। 

Content added By
Content updated By

টারসেলির পরীক্ষা

তোমরা নিশ্চয়ই স্ট্র দিয়ে কখনো না কখনো কোল্ড ড্রিংকস খেয়েছ। কখনো কি চিন্তা করেছ স্ট্রতে চুমুক দিলে কেন কোল্ড ড্রিংকস তোমার মুখে চলে আসে? আসলে ব্যাপারটি ঘটে বাতাসের চাপের জন্য। ব্যাপারটি বোঝা খুব সহজ হতো যদি তুমি কখনো 10.5 মিটার লম্বা একটা স্ট্র দিয়ে কোল্ড ড্রিংকস খাওয়ার চেষ্টা করতে। (ব্যাপারটি মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু যুক্তির খাতিরে মেনে নাও।) তাহলে তুমি আবিষ্কার করতে ড্রিংকসটা 10.3 মিটার পর্যন্ত উঠে হঠাৎ করে থেমে গেছে। আর যতই চুমুক দেওয়ার চেষ্টা করো ড্রিংকসটা উপরে উঠছে না। (আমরা ধরে নিচ্ছি কোল্ড ড্রিংকসের ঘনত্ব পানির ঘনত্বের কাছাকাছি। 

পারদ মুখে নেওয়ার মতো তরল নয় কিছু যুক্তির খাতিরে কল্পনা করো তুমি ষ্ট দিয়ে পারদ চুমুক দিয়ে মুখে আনার চেষ্টা করছ। যদি ত্রুটি 76 cm থেকে বেশি লম্বা হয় তাহলে তুমি আবিষ্কার করবে পারদ ঠিক 76 cm উচ্চতায় এসে থেমে গেছে, তুমি যতই চুমুক দেওয়ার চেষ্টা করো পারদ আর উপর উঠবে না। পানির ঘনত্ব থেকে পারদের ঘনত্ব 13.6 গুণ বেশি, তাই পানি যেটুকু উচ্চতায় উঠেছে পারদ উঠেছে তার থেকে 13.6 গুণ কম। 

এমনিতে একটি স্ট্র মুখে নিয়ে কোল্ড ড্রিংকসের বোতলে ধরে রাখলে কোল্ড ড্রিংকসটা উপরে উঠবে না। কারণ তোমার মুখের ভেতরে বাতাসের যে চাপ স্ট্র ডুবিয়ে রাখা ভরলেও সেই একই বাতাসের চাপ। দুটো চাপই সমান, কাজেই এর ভেতরে কোনো কার্যকর বল নেই। এখন যদি তুমি চুমুক দাও, যার অর্থ তুমি মুখের ভেতরে শূন্যতা তৈরি করার চেষ্টা করো তখন সেখানে বাতাসের চাপ কমে যায়। তখন তরলের উপরে বাতাসের চাপের জন্য তরলটা স্ট্র বেয়ে উপরে ওঠে। 

পারদ ব্যবহার করে বাতাসের চাপের এই পরীক্ষাটি বিজ্ঞানী টরিসেলি করেছিলেন 1643 সালে। তিনি অবশ্য মুখ দিয়ে পারদকে একটি নল বেয়ে টেনে তোলার চেষ্টা করেননি, তিনি এক মুখ বন্ধ একটা নলের ভেতর পারদ ভরে, নলটি পারদ ভরা একটা পাত্রে উল্টো করে রেখেছিলেন। পারদের উচ্চতা নামতে নামতে ঠিক 76 cm এসে থেমে গেল। তুমি চুমুক দিয়ে খাবার সময় মুখের ভেতরে যে শূন্যতা তৈরি করার চেষ্টা করো কাচের নলের উপরে ঠিক সেই শূন্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাতাস পারদের উপরে চাপ দিচ্ছে এবং সেই চাপ তরলের সব জায়গায় সঞ্চালিত হয়ে নলের নিচেও এসেছে। নলের উপরে কোনো ফুটো নেই, তাই সেদিক দিয়ে বাতাস চাপ দিতে পারছে না। কাজেই সমতা আনার জন্য নলের নিচে এক মাত্র চাপ হচ্ছে 76 cm উঁচু পারদ স্তম্ভের ওজনের কারণে তৈরি হওয়া চাপ।

বাতাসের চাপ মাপার যন্ত্রের নাম ব্যারোমিটার এবং টরিসেলির এই পদ্ধতি দিয়ে তৈরি ব্যারোমিটারে এখনো বাতাসের চাপ মাপা হয়। বাতাসের চাপ বাড়লে পারদের উচ্চতা 76 cm থেকে বেশি হয়, চাপ কমলে উচ্চতা 76 cm থেকে কমে যায়। 

Content added By
Content updated By

বাতাসের চাপ এবং আবহাওয়া

বাতাসের চাপের সাথে আবহাওয়ার খুব ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক আছে। তোমরা নিশ্চয়ই আবহাওয়ার খবরে অনেকবার সমুদ্রে নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার কথা শুনেছ, যার অর্থ সেখানে বাতাসের চাপ কমে পেছে। তখন চাপ সমান করার জন্য আশপাশের উচ্চ চাপ এলাকা থেকে বাতাস সেই নিম্নচাপের দিকে আসতে থাকে এবং মাঝে মাঝে একটা ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়, সেই ঘূর্ণিটি বিশেষ অবস্থায় ঘুর্ণিঝড়ের সৃষ্টি করে। আমাদের দেশে ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতার খবর তোমরা নিশ্চয়ই জানো। 

তোমরা যখন পরের অধ্যায়ে তাপ এবং ভাগযাত্রা সম্পর্কে পড়বে তখন তোমরা জানতে পারবে যে বাতাসের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সেটি প্রসারিত হয় বলে তার ঘনত্ব কমে যায় এবং চাপ কমে যায়। বাতাসের চাপ আরো কার্যকরভাবে কমে, যদি তার মাঝে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যায়। জলীয় বাষ্প হচ্ছে পানি, পানির অণুতে একটি অক্সিজেন এবং দুটি হাইড্রোজেন থাকে এবং পানির অণুর আণবিক ভর হচ্ছে (16 + 1 + 1 =) 18। বাতাসের মূল উপাদান হচ্ছে নাইট্রোজেন (পারমাণবিক ভর 14) দুটো পরমাণু দিয়ে তৈরি হয় তাই তাদের আণবিক ভর (14 + 14 =) 28 এবং অক্সিজেন (পারমাণবিক ভর 16), এটিও দুটি পরমাণু দিয়ে তৈরি তাই আণবিক ভর (16 + 16 =) 32 যা পানির আণবিক ভর থেকে অনেক বেশি। তাই যখন বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকে তখন বেশি আণবিক ভরের নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেনের বদলে কম আণবিক ভরের পানির অণু স্থান করে নেয় কাজেই বাতাসের ঘনত্ব কমে যায়। বাতাসের ঘনত্ব কম হলে বাতাসের চাপও কমে যায়। কাজেই ব্যারোমিটারে বাতাসের চাপ দেখেই স্থানীয় আবহাওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। ব্যারোমিটারে উচ্চ চাপ দেখালে বোঝা যায় বাতাস শুকনো এবং আবহাওয়া ভালো। চাপ কমতে থাকলে বোঝা যায় জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ছে। চাপ বেশি কম দেখালে বুঝতে হবে আশপাশের এলাকা থেকে বাতাস ছুটে এসে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হতে যাচ্ছে। 

Content added || updated By
Promotion